Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ

প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস সাড়ম্বরে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে। ১৯৪৫ সালের ১৬ অক্টোবর দিনটিতে জাতিসংঘের অন্যতম একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান Food and Agriculture Organization (FAO) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মানুষের প্রধানতম মৌলিক চাহিদা হলো তার খাদ্য। মানবজাতির অস্তিত্বের প্রশ্নে খাদ্যের অপরিহার্যতা, এর ব্যাপ্তি, সীমাবদ্ধতা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যে ১৬ অক্টোবরকে প্রতি বছর বিশ্ব খাদ্য দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বিভিন্ন বছরে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্য নিয়ে এ দিবস পালিত হয়। এ বছর বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০১৯ এর প্রতিপাদ্য হলো  ‘Our Actions are our Future. Healthy diets for a # Zero Hunger world প্রতিপাদ্যের বাংলা ভাবার্থ নির্ধারণ করা হয়েছে ‘আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ,  পুষ্টিকর খাদ্যেই হবে আকাক্সিক্ষত ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী’ বিশ্বের বর্তমান বাস্তবতায় এবারের প্রতিপাদ্য সময়োপযোগী ও যথার্থ বলেই বিবেচিত হয়। কারণ ‘আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ এতো অমোঘবাণী। ব্যক্তি জীবনের কর্মফল যেমন তার জীবনের  ভবিষ্যৎকে বহুলাংশে প্রভাবিত করে তেমনি মানবজাতির সামষ্টিক কর্মফলও তার ভবিষ্যৎ পথ নির্দেশ করে। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় জীবনটাকে আরও একটু উন্নততর বা আয়েশি করার জন্য বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডর ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি, জীব জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বিভিন্ন অভিঘাত এখন সর্বত্র অনুভ‚ত হচ্ছে। যার পরিণতিতে এ গ্রহটির ভষ্যিৎ নিয়েই অনেক চিন্তাবিদ, গবেষক আতক্কিত বোধ করছেন। ভবিষ্যতের এই যে শঙ্কা বা আতঙ্ক মানবজাতির সামগ্রিক কর্মফলেরই পরিণতি বলে বিশ্বাসযোগ্য কারণ রয়েছে।


বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০১৯ এর প্রতিপাদ্যের অপর অংশ ‘পুষ্টিকর খাদ্যেই হবে আকাক্সিক্ষত ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী’ বা Zero Hunger world। এটাও সময়ের বাস্তবতায় যথার্থ। শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি সাধন ও ক্ষয়পূরণের জন্য মানুষ যা খায় তাই তার খাদ্য। পুষ্টি উপাদান অনুযায়ী খাদ্যেরও শ্রেণী বিভাগ আছে। তবে  ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়তে হলে দু’টি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত, পুষ্টিকর খাবারের পর্যাপ্ততা (availability) নিশ্চিতকরণ দ্বিতীয়ত সব জনগোষ্ঠীর জন্য খাবার প্রাপ্তির সামর্থ্য (affordable) নিশ্চিতকরণ। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর অমর্ত্য সেন বলেছেন শুধুমাত্র খাদ্যের পর্যাপ্ততা কোনো দেশ বা জাতিকে ক্ষুধামুক্ত করতে পারে না যতক্ষণ না সব জনগোষ্ঠীর জন্য ওই খাদ্য প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। ‘ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী’ শব্দ দু’টি বলতে ও শুনতে অন্তরে অনাবিল প্রশান্তি জাগায় বটে কিন্তু বাস্তবতা বহু দূর। এখনও এ পৃথিবীর অনেক দেশ অনেক জাতিগোষ্ঠী আছে যারা চরম দারিদ্র্য অথবা দারিদ্র্যসীমায় অবস্থান করছে, তাদের বেঁচে থাকার স্বাভাবিক খাবারই নিশ্চিত করা যায়নি সেখানে  পুষ্টিকর খাবার তো বিলাসী স্বপ্ন। আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন- FAO, IFAD, WFP, IFPR  প্রভৃতি বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে । এসব সংস্থা তাদের নিজস্ব কর্ম পরিকল্পনার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সরকার প্রণীত কৃষি ও খাদ্যসংশ্লিষ্ট প্রকল্প অথবা কর্মসূচিতে সহায়তার মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনে ভূমিকা রাখছে ফলশ্রুতিতে বিশ্বের অনেক দেশে দারিদ্র্যের হার কমছে।


আমরা যদি আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনের চিত্র পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাই এক অনন্য সাফল্যগাথা। মাত্র দেড় দশকেরও কম সময়ে আমাদের দারিদ্রতা যে হারে কমেছে তা অনেক দেশের জন্যই অনুকরণীয়। বিবিএসের সর্বশেষ তথ্যে বলা হয়েছে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের দারিদ্রতার হার নেমে এসেছে ২১.৮% যা ২০০৫ সালে ছিল ৪০% এবং ২০১৬ সালে ছিল ২৪.৩%। অন্যদিকে ২০১৮ সালে চরমদারিদ্র্যের (extreme poverty) হার নেমে হয়েছে ১১.৩% যা ২০০৫ সালে ছিল ২৫.১% এবং ২০১৬ সালে ছিল ১২.৯%। কৃষির কথা যদি বলি সেখানে আরেক সাফল্যগাথা। বিগত এক দশকে কৃষির সবগুলো সেক্টর-ফসল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। এফএও এর বাংলাদেশ কার্যালয় ২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বর পূর্বাভাস দিয়েছিল ২০১৮-’১৯ অর্থবছরে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। পূর্বাভাস যথার্থই ছিল, ডিএইর সূত্রে জানা যায় ফসল সেক্টরে শুধু দানাদার শস্যের উৎপাদনই এখন চার কোটি টনের উপরে, গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন মিলিয়ে শাকসবজির উৎপাদন দেড় কোটি টন, দেশে প্রচলিত স্বল্প প্রচলিত এবং বিদেশী ফল যেগুলো এখানে অভিযোজিত হয়েছে সবমিলিয়ে ফলের উৎপাদন এখন কোটি টনের উপরে। ফল সবজির উৎপাদন শুধু বাড়েনি এর বহুমুখীকরণও হয়েছে। তাই তো দেশের বাজারে সব সময় বৈচিত্র্যময় শাকসবজি ও ফলের সমাহার দেখা যায়।


নিরাপদ পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য শস্য উৎপাদন ও খাদ্যের সহজলভ্যতা বজায় রাখতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য অধিদপ্তর এবং প্রতিষ্ঠানের সাথে তাল মিলিয়ে হর্টেক্স ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে। হর্টেক্স ফাউন্ডেশন কৃষিপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য যেমনভাবে কৃষিপণ্য ব্যবসায়ীদের কারিগরি প্রযুক্তি ও বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে ঠিক তেমনি রপ্তানিযোগ্য নিরাপদ কৃষিপণ্য উৎপাদনে কৃষক পর্যায়ে কাজ করছে। ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রোগ্রাম ফেজ ওও প্রজেক্টে কৃষি সম্প্রসারণ অদিপ্তর এর সাথে হর্টেক্স ফাউন্ডেশন কৌশলগত অংশীদার হিসেবে ফসল সংগ্রহোত্তর ব্যবসথাপনা ও কৃষিপণ্যের বাজার উন্নয়নের উপর ৩০টি উপজেলায় কাজ করছে। প্রকল্প এলাকায় লাভজনকভাবে কৃষিপণ্য বিক্রয়ের লক্ষ্যে কৃষিপণ্য সংগ্রহকরণ ও বাজারজাতকরণ কেন্দ্র  (সিসিএমসি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ঈড়সসড়হ ওহঃবৎংবঃ এৎড়ঁঢ় (ঈরএ)এর কৃষকদের সংগঠিত করে চৎড়ফঁপবৎ ড়ৎমধহরুধঃরড়হ গঠিত হয়েছে। এ সংগঠনের সদস্যগণের মধ্য হতে গঠিত বাজার পরিচালনা কমিটির দর কৃষকের মাধ্যমে   লাভজনকভাবে সিসিএমসিতে কৃষিপণ্য বিক্রয়ের ব্যবস্থা গড়ে উঠতেছে। নিরাপদ ফসল উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা যেমন ফসল সংগ্রহ সময়কাল (গধঃঁৎরঃু ওহফবী), সংগ্রহ কৌশল, সর্টিং, ধৌতকরণ (ওয়াশিং), গ্রেডিং, প্যাকিং ইত্যাদি প্রযুক্তি সমৃদ্ধ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষক ও কৃষিপণ্য ব্যবসায়ীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে হর্টেক্স ফাউন্ডেশন দেশ ও বিদেশের বাজারে নিরাপদ ফসল বাজারজাত করণে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখছে। প্রযুক্তি ও বিশেষায়িত পরামর্শমূলক সেবা দানের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতি ও কৃষকের আয় বৃদ্ধিতে রপ্তানির জন্য উচ্চ মূল্যের কৃষিপণ্যসহ কৃষি ব্যবসা উন্নততর ও বহুমূখী করাই হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের মূল লক্ষ্য।


দেশের মৎস্য সেক্টরের উন্নতিও ঈর্ষণীয়। বিবিএসের তথ্যে জানা যায়, দেশের সবগুলো উৎস থেকে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে যেখানে মাছ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৩২৮৫৪৫ মে.টন সেখানে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ৪১৩৪৪৩৪ মে.টন। প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৬০%। বিগত দুই বছরে মাছের উৎপাদন আরও বেড়েছে। মৎস্য সেক্টরে বাংলাদেশ আরও একটা বিরল সম্মান অর্জন করেছে এফএও এর তথ্য মতে, ২০১৮ সনে অভ্যন্তরীণ জলজ উৎস (রহষধহফ ধিঃবৎ ংড়ঁৎপব ) থেকে মাছ আহরণে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে। অথচ পূর্ববর্তী বছরের অবস্থান ছিল পঞ্চম। এক্ষেত্রে চীন প্রথম ভারত দ্বিতীয়। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক পুনর্নিরীক্ষণ তথ্য অনুযায়ী এখন দেশে মাথাপিছু প্রতিদিন মাছ গ্রহণের পরিমাণ ৬২.৫ গ্রাম যেখানে প্রয়োজন ৬০ গ্রাম। “ঞযব ঝঃধঃব ড়ভ ডড়ৎষফ ঋরংযবৎরবং ধহফ অয়ঁধপঁষঃঁৎব ২০১৮” রিপোর্ট   অনুযায়ী সামগ্রিক মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম।
কৃষির আর একটি সেক্টর হলো প্রাণিসম্পদ যেটি মাংস, ডিম, দুধ ও দুগ্ধজাত উপাদেয় ও পুষ্টিকর খাবারের উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাংসের উৎপাদন হয় ৭১.৫০ লক্ষ মে.টন। দেশে মাংসের চাহিদা ৭১.৩৫ মে.টন। মাথাপিছু প্রতিদিন মাংসের চাহিদা ১২০ গ্রামের বিপরীতে উৎপাদন ১২১.৭৪ গ্রাম। উল্লিখিত তথ্যে দেখা যায় মাংসের চাহিদার পুরোটাই দেশে উৎপাদন হচ্ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ডিমের উৎপাদন হয়েছে ১৫.৫২ বিলিয়ন, এক দশক আগেও যার উৎপাদন ছিল ৫.৬৫ বিলিয়ন। ডিমের বার্ষিক চাহিদা ১৭.১৩ বিলিয়ন। চাহিদার বিপরীতে দেড় বিলিয়নের কিছু বেশি ঘাটতি আছে। নয়-দশ বছর আগে বার্ড ফ্লু দুর্যোগে দেশের উদীয়মান পোল্ট্রি শিল্প বিপর্যয়ের মধ্যে না পড়লে হয়তো ডিমের এ ঘাটতি থাকত না। তবে আশার কথা পোলট্রি শিল্প ঘুরে দাঁড়ানোর পথে আছে। দেশে বর্তমানে দুধের চাহিদা ১৫.০৪ মিলিয়ন টনের বিপরীতে ২০১৮ সনে উৎপাদন মাত্র ৯.৪ মিলিয়ন টন। অবশ্য “ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঋধৎস ঈড়সঢ়ধৎরংড়হ ঘবঃড়িৎশ (ওঋঈঘ )” এর ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৮ সনে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ ৮.০৮ মিলিয়ন টন। পরিসংখ্যানে দেখা যায় দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যে এখনও অনেক ঘাটতি আছে, তবে এ ঘাটতি পূরণে নানামুখী কর্ম পরিকল্পনা চলছে। আশা করা যায় ভবিষ্যতে দুধের ঘাটতি কমে যাবে।


দারিদ্র্য বিমোচন, কৃষি, অবকাঠামো, সামাজিক নিরাপত্তাসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনেকগুলো সূচকের অভাবনীয় সফলতা সম্ভব হয়েছে সরকারের সঠিক নীতি সহায়তা, প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কারণে। বর্তমান দেশে খাদ্যের প্রাচুর্যতা এবং অন্যান্য আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটায় সব ধরনের জনগোষ্ঠীর ভোগ চাহিদা বেড়ে গেছে, বেড়েছে পূর্বাপেক্ষা পুষ্টিমান সম্মৃদ্ধ খাবার গ্রহণের পরিমাণ, তাই বেড়েছে জনগণের গড় আয়ু (বিবিএসের তথ্যানুযায়ী ৭২ বছর)। সামগ্রিক অর্থনীতির আশা জাগানিয়া প্রবৃদ্ধি হলেও এখনও আমরা চরমদারিদ্র্য বা দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হতে পারিনি। বিশ্ব খাদ্য দিবসের সেøাগান অনুযায়ী দেশের সব জনগোষ্ঠীর জন্য পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবীর অংশ হতে এখনও পারিনি বটে তবে সেøাগানের আর এক অংশ ‘আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষৎ’ সামনের পথ নির্দেশনা দেয়। বিগত দশকের অভূতপূর্ব উন্নয়নের উদীপ্ত কর্মফলের ধারাবাহিকতা আগামীতে চলমান রাখতে পারলে আমরা আশান্বিত হতেই পারি ২০৩০ সালের এসডিজি গন্তব্যে বাংলাদেশ হবে ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত দেশ এবং ক্ষুধামুক্ত পৃথিবীর গর্বিত অংশীদার।

 

কৃষিবিদ মোঃ মনজুরুল হান্নান১কৃষিবিদ মোঃ কুদরত-ই-গনী২
১ব্যবস্থাপনা পরিচালক ২পরিচালক (অবঃ), ডিএই ও ট্রেনিং ম্যানেজমেন্ট এক্সপার্ট এনএটিপি-২, হর্টেক্স ফাউন্ডেশন, সেচ ভবন, মানিক মিয়া, এভিনিউ, ঢাকা, মোবাইল নং ০১৭১১৮১৬৪৫২, Email: qghani57@gmail.com ,

আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ

ড. মোঃ নাজিরুল ইসলাম১ ড. মোঃ ওমর আলী২

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর জন্মলগ্ন থেকেই এদেশের আবহাওয়া উপযোগী এবং কৃষকের আর্থসামাজিক অবস্থার সাথে সংগতিপূর্ণ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে জাতীয় কৃষি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। শরীর সুস্থ রাখতে হলে সুষম খাদ্যের যোগান অত্যাবশ্যক। একটি বহু ফসল ভিত্তিক গবেষণা- প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিএআরআই ২১১টি ফসল নিয়ে গবেষণা করে এ পর্যন্ত বিভিন্ন ফসলের ৫৭৯টি উচ্চফলনশীল আধুনিক জাত এবং ৫৫১টি বিভিন্ন প্রযুক্তিসহ মোট ১১৩০টিরও অধিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। আর আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ যা আমাদের  জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে এক অনন্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। বিএআরআই সেই সুষম ও নিরাপদ খাদ্যের যোগান দিতেই এই প্রতিপাদ্যকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে বিএআরআই নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে যে সাফল্য লাভ করেছে এবং যে সমস্ত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে চলেছে তার উল্লেখযোগ্য কিছুকার্যক্রম উপস্থাপন করা হলো।
কন্দাল ফসল
বিএআরআই-এর কন্দাল ফসল গবেষণা কেন্দ্র থেকে আজ পর্যন্ত উদ্ভাবিত আলুর ৯১টি উচ্চফলনশীল জাত অনুমোদন লাভ করেছে। এছাড়া বারি টিপিএস-১ এবং বারি টিপিএস-২ নামে ২টি হাইব্রিড আলুর জাত প্রকৃত আলুবীজ থেকে উদ্ভাবন করা হয়েছে। মিষ্টি আলুর ১৬টি, পানি কচুর ৬টি, মুখীকচুর ২টি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং এ জাতগুলোর অধিকাংশই পুষ্টি সমৃদ্ধ এবং অধিক উৎপাদনশীল।
ডাল
ডাল বাংলাদেশের ফসল ধারায় প্রকৃতির দান এক অনন্য নিয়ামক, যা শুধু ডালই উৎপাদন করে পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে না অধিকন্তু, মাটির ঊর্বরতা বৃদ্ধি করে এক পরিবেশবান্ধব কৃষি উপহার দেয়। ডালে জাতভেদে বিদ্যমান আমিষ      (২০-২৮%) এবং পর্যাপ্ত অ্যামাইনো এসিডসহ নানাবিধ পুষ্টি উপাদানের কারণেই আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য সংস্কৃতিতে ডাল এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ডালে বিদ্যমান আমিষের পরিমাণ গমের চেয়ে দ্বিগুণ এবং ভাতের চেয়ে তিন গুণ বেশি। ডালের পুষ্টিসহজেই হজমযোগ্য। এজন্য ডালকে গরিবের মাংস বলা হয়। বর্তমানে করোনা মহামারীর সময়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি করোনা ভাইরাসসহ নানাবিধ সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে ডালের রয়েছে অনন্য ভূমিকা। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী ডালের উৎপাদন বৃদ্ধি। লক্ষ্যেই  বিএআরআই-এর ডাল গবেষণা কেন্দ্র ডালের ৪৩টি উন্নতজাত ও সংশ্লিষ্ট উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, আমরা যদি প্রতিদিন পুষ্টি সমৃদ্ধ ডাল বিশেষ করে আয়রন, জিংক ও সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ মসুর ডাল খাই তাহলে আলাদা করে আয়রন ও জিংক ট্যাবলেট খাওয়া প্রয়োজন হবে না।
তেলবীজ
বাংলাদেশের কৃষিতে বিভিন্ন প্রকারের তেলবীজ ফসলের মধ্যে সরিষা এদেশে প্রধান যা তেল ফসলের আবাদি এলাকার শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ জমিতে চাষ করা হয়। তেলবীজ গবেষণা কেন্দ্র এ পর্যন্ত সরিষা, তিল, চীনাবাদাম, সয়াবিন, সূর্যমুখী, তিসি ইত্যাদি বিভিন্ন তেল ফসলের মোট ৪৩টি জাতসহ বেশ কিছু অন্যান্য উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। উদ্ভাবিত জাতের উৎপাদন ক্ষমতা আগের প্রচলিত জাতসমূহের চেয়ে অনেক বেশি। সরিষার উদ্ভাবিত জাতগুলোর মধ্যে বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৭ জাতটির ফলন ক্ষমতা প্রচলিত জাত টরি-৭ এর চেয়ে শতকরা ১৫-২০ ভাগ বেশি। এ জাতটি স্বল্পমেয়াদি (৮০-৮৫ দিনে পাকে) বিধায় রোপা আমন ও বোরো ধান চাষের মধ্যবর্তী সময় আবাদ করা সম্ভব। বারি সরিষা-১৮ খুবই উচ্চফলনশীল। তেলের এ সমস্তজাতসমূহ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তেলের চাহিদা পূরণপূর্বক পুষ্টি চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে।
সবজি
সুস্থ সবল জীবনের জন্য প্রতিদিন পরিমিত পরিমাণ বিভিন্ন ধরনের সবজি খাওয়া অপরিহার্য। কারণ জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যক ভিটামিন ও খনিজের অন্যতম উৎস হল সবজি। বাংলাদেশে বর্তমানে দৈনিক মাথাপিছু সবজি গ্রহণের পরিমাণ প্রায় ৭০ গ্রাম (বিবিএস ২০১৮) যা অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে প্রায় সাড়ে তিন ভাগের ১ ভাগ। পুষ্টিবিদগণ দৈনিক মাথাপিছু ২২০ গ্রাম সবজি খাওয়ার পরামর্শ দেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সবজির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে এ পর্যন্ত মোট ৩৫টি সবজির ১৩২টি উন্নত জাতসহ (ওপি-১০৫, হাইব্রিড-২৩ ও বিটি-৪) উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। গ্রীষ্ম মৌসুমে সবজির আবাদ এবং বীজ উৎপাদনের প্রযুক্তিও উদ্ভাবিত হয়েছে। এসব উন্নত সবজির জাত ও প্রযুক্তি দেশে সবজির চাহিদা পূরণে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে এবং ভবিষ্যতেও রাখবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায়।
বসতবাড়ির আঙ্গিনায় সবজিচাষ
বাংলাদেশের কৃষিতে বসতবাড়ির আঙ্গিনায় সবজি চাষ উৎপাদন পদ্ধতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এদেশে মোট কৃষি পরিবারভুক্ত বসতবাড়ির সংখ্যা ১ কোটি ৩৫ লক্ষ ১২ হাজার ৫৮০ লাখ, যার গড় আয়তন ৩৫০ বর্গ মিটার। পরিকল্পিত নিবিড় চাষ প্রবর্তনের মাধ্যমে বাড়ির আঙ্গিনায় সবজি উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি করা যেতে পারে। অধিক সবজি উৎপাদনের উদ্দেশ্যে বিএআরআই এর সরেজমিন গবেষণা বিভাগ বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য সবজি চাষের ৯টি মডেল উদ্ভাবন করেছেন। এ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের প্রকট পুষ্টি সমস্যার সমাধান এবং পুষ্টি সমস্যাজনিত রোগ-বালাই থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া অতিসহজে সম্ভব।  বর্তমানে সরকার এ কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করতে ‘আমার বাড়ী আমার খামার’ শিরোনামে প্রকল্প গ্রহণ করেছেন, যা এ দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা মিটিয়ে সুস্থ শরীর গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
ফুল ও ফল
মানুষের পেটের ক্ষুধানিবারণের পাশাপাশি মনের ক্ষুধানিবারণ একটি বড় বিষয়। আর ফুলও তেমনই একটি মাধ্যম, যা মনের ক্ষুধানিবারণ করে। আর সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই সাম্প্রতিককালে বিএআরআই ফুল বিভাগ ১২টি ফুলের ২১টি জাত উদ্ভাবন করেছেন। আশা করা হচ্ছে বাংলাদেশ আগামীতে ফুল রপ্তানি করে উল্লেখযোগ্য হারে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সক্ষম হবে।
মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় ফল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে একজন মানুষের দৈনিক ২০০ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন কিন্তু আমরা খাই মাত্র ৮২ গ্রাম। ফল ওষধি গুণাগুণে সমৃদ্ধ বিধায় একে ’রোগ প্রতিরোধী খাদ্যও’ বলা হয়। এসমস্ত বিষয়ের প্রতি খেয়াল রেখেই ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত¡ গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই ৩৫ প্রজাতির ফলের ৮৬টি জাত উদ্ভাবন করেছে, যার অধিকাংশই মাঠ পর্যায়ের ফলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। নিয়মিত ও পরিমিত পরিমাণে এ সকল ফল গ্রহণে দেহের ভাইরাস যেমন কোভিড-১৯ সহঅন্যান্য রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, যা সুস্থ সবল ও মেধাবী জাতি বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
মসলা
মসলা গবেষণা কেন্দ্র গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন মসলার মোট ৪৪টি জাতও উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। উল্লেখ্য যে, মসলা শুধু খাবারের স¦াদ বৃদ্ধিতেই নয়, সুস্থতার জন্য ও জরুরী।
বালাই ব্যবস্থাপনা
শস্য উৎপাদনে বিএআরআই প্রায় ২১১টির মতো ফসলকে রোগ এবং পোকামাকড় মুক্ত রাখার জন্য গবেষণার কাজ পরিচালনা করে আসছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ফসলের প্রায় ১০০০টি রোগ আজ পর্যন্ত শনাক্ত করা হয়েছে। এ দেশে ধানসহ অন্যান্য ফসলে ৭০০-এর বেশি পোকামাকড় শনাক্ত করা হয়েছে। সমনি¦তবালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে বিএআরআই কাজ করে চলেছে।
কৃষি যন্ত্রপাতি
কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ফলে কৃষি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে যান্ত্রিক চাষাবাদ প্রচলনের ফলে অল্পসময়ে জমি চাষ করে সময়মতো পরবর্তী ফসল বপন করা সম্ভব হয়েছে। ফলশ্রæতিতে, মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে পাশাপাশি পুষ্টির প্রাপ্যতাও বাড়ছে।
সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা
বর্তমানে মোট আবাদযোগ্য জমির ৭০ শতাংশ সেচের  আওতাধীন রয়েছে। সেচ দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ সেচসম্পর্কিত বেশ  কিছু তথ্য গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে।
খামার পদ্ধতি গবেষণা
দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে মোট ৯টি খামার পদ্ধতি গবেষণা এবং ৭২টি বহুস্থানিক গবেষণা এলাকা আছে। খামার পদ্ধতি গবেষণার মাধ্যমে কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের ভিত্তিতে উন্নত শস্যবিন্যাস, শস্যভিত্তিক সার ব্যবস্থাপনা এবং স্থানীয় সমস্যার ভিত্তিতে প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়।
জৈব প্রযুক্তি
জৈব প্রযুক্তি বর্তমান সময়ে ফসলের জাত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। উন্নতবিশে^ এর মাধ্যমে জিন প্রতিস্থাপন করে উন্নত উচ্চফলনশীল জাত, রোগমুক্ত ও পোকামাকড়রোধী জাত উদ্ভাবন করা যায়। এ পদ্ধতিতে জীব বৈচিত্র্যের মলিকুলার চরিত্রায়ন করা হয়ে থাকে, যা নতুন জাত উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া অল্পসময়ে অধিক পরিমাণে রোগমুক্ত চারা উৎপাদনের মুখ্য ভূমিকা রাখে।
শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি
শস্য সংগ্রহোত্তর উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মাধ্যমে খাদ্যশস্য, সবজি ও ফলমূলের অপচয় রোধ এবং পুষ্টি গুণাগুণ অক্ষুণ রাখবে।  ফল ও সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রযুক্তিসমূহ উদ্ভাবনে দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।
সর্বোপরি, বলা যায় এ দেশের কৃষির সার্বিক উন্নয়নে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বিজ্ঞানীবৃন্দের দেশের প্রয়োজনে ও সমস্যাসম্পর্কে সচেতন তাদের পেশাগতজ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং প্রচেষ্টা আর আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বর্তমানে নির্মিত আগামী দিনের কৃষি উন্নয়ন। য়

১মহাপরিচালক, বিএআরআই, গাজীপুর, ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ডাল গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৭১২৫৪৩৭২০, ই-মেইল : omaraliprc@gmail.com

 

মৎস্য খাত : আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ

কাজী শামস আফরোজ

‘সবাই নিয়ে একসাথে বিকশিত হোন, শরীরের যতœ নিন, সুস্থ থাকুন। আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ’। এ প্রতিপাদ্যে উদযাপন হচ্ছে এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২০। যা অত্যন্ত সময়োপযোগী। বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়ন ও কাক্সিক্ষত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজি অর্জনে খাদ্য নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশের আপামর জনগণের পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের যোগান আজ অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এ দেশের ক্রমবর্ধিষ্ণু ১৬ কোটির অধিক জনগোষ্ঠীর জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ প্রাণিজ আমিষ সরবরাহের মাধ্যমে সুষম খাবারের নিশ্চয়তা বিধানে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্যের অবদান সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি সেক্টর-সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে মৎস্যখাতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মোট জিডিপির ৩.৫০ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির এক-চতুর্থাংশের বেশি (২৫.৭২ শতাংশ) মৎস্যখাতের অবদান (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯)। বিগত ৫ বছরে মৎস্যখাতে গড়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৬.২৮ শতাংশ। দেশের রপ্তানি আয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ আসে মৎস্যখাত হতে। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশের অধিক মানুষ এ সেক্টরের বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়োজিত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে।


মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশ আজ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশের সাফল্য আজ বিশ্বজন স্বীকৃত। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ২০২০ রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী মৎস্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার ধীরগতিসম্পন্ন হলেও বিগত এক দশকে বাংলাদেশের মৎস্য উৎপাদনের গড় প্রবৃদ্ধির হার ৯.১%, যা বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় এবং বিশে^ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে বাংলাদেশ ৩য় স্থান এবং বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে ৫ম স্থান যথারীতি ধরে রেখেছে। পাশাপাশি বিশ্বে সামুদ্রিক ও উপক‚লীয় ক্রাস্টাশিয়ান্স ও ফিনফিস উৎপাদনে যথাক্রমে ৮ম ও ১২তম স্থান অধিকার করেছে।


সর্বোপরি মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মৎস্য অধিদপ্তর ইতোমধ্যেই বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার ১৪২৩ এ স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হয়েছে। এসব অর্জন সরকার কর্তৃক মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে বাস্তবায়িত যথোপযুক্ত কার্যক্রমেরই ফলাফল।


ভিশন-২০২১, বাংলাদেশ ঃ সমৃদ্ধ আগামী প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। তাছাড়া নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লিখিত অগ্রাধিকারমূলক সেক্টর-সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমসমূহ বিশেষত- পুষ্টিসম্মত ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা, দারিদ্র্য নির্মূল, আধুনিক কৃষি-ব্যবস্থা- লক্ষ্য যান্ত্রিকীকরণ, বøু-ইকোনমি- সমুদ্রসম্পদ উন্নয়ন-কে সামনে রেখে সমন্বিত উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) এর মৎস্য সেক্টর-সংশ্লিষ্ট লক্ষ্যমাত্রাসমূহ অর্জনের উদ্দেশ্যে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যকে টেকসই করার লক্ষ্যে সরকার চলমান বহুবিধ সমাজ ও পরিবেশবান্ধব কার্যক্রমের পাশাপাশি অন্যান্য সময়োপযোগী ও লাগসই কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে গৃহীত উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমসমূহ হলো:


অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের আবাসস্থল উন্নয়ন এবং প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ; বদ্ধ জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে উৎকর্ষতা সাধন; পরিবেশ ও সমাজবান্ধব চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণ; সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের সহনশীল আহরণ, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা; জাটকা সংরক্ষণ ও ইলিশ সম্পদ ব্যবস্থার উন্নয়ন; পুষ্টি-সংবেদনশীল মৎস্যচাষ ব্যবস্থা প্রবর্তন ও সচেতনতা বৃদ্ধি; সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রমের পরিধিসম্প্রসারণ; এবং স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।


নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি যোগানে মাছ
বিবিএস’র ২০১৬-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী জনপ্রতি প্রতিদিন মাছ গ্রহণের পরিমাণ ঈপ্সিত চাহিদার (৬০ গ্রাম) চেয়ে বৃদ্ধি পেয়ে ৬২.৫৮ গ্রাম-এ উন্নীত হয়েছে। আমাদের খাদ্যে প্রাপ্ত প্রাণিজ আমিষের  প্রায় ৬০ শতাংশ যোগান দেয় মাছ। মাছ একটি উচ্চ আমিষসমৃদ্ধ দামে সস্তা ও সহজ পাচ্য, কম চর্বি ও শ্বেতসার যুক্ত নিরাপদ খাদ্য। মানুষের দেহের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানগুলোর সবগুলো উপাদানই সুষম পরিমাণে মাছে বিদ্যমান।  
কোভিড-১৯ কালীন মৎস্য সাপ্লাই চেইন উন্নয়ন: কোভিড-১৯ কালীন মৎস্যচাষিদের মাছ বাজারজাতকরণ গতিশীল করতে মৎস্য অধিদপ্তর স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় কতিপয় ফলপ্রসূ কার্যক্রম গ্রহণ করে; যা মৎস্যচাষিদের আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু রাখতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এটি সুধীমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত ও প্রশংসিত হয়। কার্যক্রম হলো ভ্রাম্যমাণ মাছ বিক্রয় কেন্দ্র/ গ্রোথ সেন্টারের মাধ্যমে মাছ বিক্রয়; অনলাইনে মাছ বাজারজাতকরণ এবং দরিদ্র্য ও অসহায় মানুষকে ত্রাণের সাথে মাছ বিতরণ।


স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ মাছ সরবরাহে গৃহীত পদক্ষেপ
 

১. আইনি পরিকাঠামো তৈরি : জনস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও রপ্তানির দ্রব্য মৎস্য অধিদপ্তর বহুমাত্রিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। আইনি কাঠামোর আওতায় প্রণীত হয়েছে আইন, বিধিমালা, নীতি ও গাইডলাইন এবং এগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তন্মধ্যে মৎস্য হ্যাচারি আইন, ২০১০ ও মৎস্য হ্যাচারি বিধিমালা, ২০১১; মৎস্য ও পশুখাদ্য আইন, ২০১০ ও মৎস্য খাদ্য বিধিমালা, মৎস্য ও মৎস্য পণ্য (পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৮৩, এবং মৎস্য ও মৎস্য পণ্য (পরিদর্শন ও  মাননিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ১৯৯৭ (সংশোধিত ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৭); জাতীয়  চিংড়ি নীতিমালা, ২০১৪; মৎস্য সঙ্গনিরোধ আইন, ২০১৮; ন্যাশনাল রেসিডিউ কন্ট্রোল প্ল্যান ও পলিসি গাইডলাইন্স ২০১১; ফিস এন্ড ফিসারি প্রোডাক্টস অফিসিয়াল কন্ট্রোল প্রোটোকল ২০১৫; অ্যাকোয়াকালচার মেডিসিনাল প্রোডাক্টস কন্ট্রোল গাইডলাইন্স ২০১৫ অন্যতম।
 

২. উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলন ও ব্যবস্থাপনা : বাজারে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মাছ/চিংড়ি সরবরাহের অন্যতম শর্ত হলো উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলনের পাশাপাশি উত্তম ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন। সঠিক উৎপাদন পরিকল্পনা প্রণয়নের পাশাপাশি এ ব্যবস্থাপনার আওতায় নি¤œবর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ ধাপসমূহ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জৈবনিরাপত্তা বিবেচনায় রেখে খামার স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা। মজুদপূর্ব এবং মজুদকালীন ব্যবস্থাপনার প্রতিটি ধাপে উত্তম চাষ ব্যবস্থা অনুসরণ।


৩. ন্যাশনাল রেসিডিউ কন্ট্রোল প্ল্যান বাস্তবায়ন ((NRCP)) : ন্যাশনাল রেসিডিউ কন্ট্রোল প্ল্যান  কার্যক্রমের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ভোক্তার জন্য বাংলাদেশী মৎস্যপণ্য নিরাপদ করা। এনআরসিপি কার্যক্রমের মাধ্যমে মৎস্য ও মৎস্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য হলো দূষণের সহনশীল সীমা ও সর্বোচ্চ অবশিষ্টাংশের সীমার জন্য নির্ধারিত সম্মত নীতির সামঞ্জস্যতা মূল্যায়ন করা, নিষিদ্ধ/অননুমোদিত পদার্থের অবৈধ ব্যবহার উদঘাটন করা এবং দূষণ অবশিষ্টাংশের উৎস নির্ণয় করা।


৪. মৎস্য মাননিয়ন্ত্রণ ল্যাবরেটরি পরিচালনা
আন্তর্জাতিক বাজারে স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের আওতায় তিনটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মৎস্য মাননিয়ন্ত্রণ ল্যাবরেটরি পরিচালিত হচ্ছে। মৎস্য ও মৎস্যজাতপণ্যের মাননিয়ন্ত্রের সাফল্যের স্বীকৃতস্বরূপ ২০১৫ সালে
EU-FVO Audit Team –এর সুপারিশে মৎস্যপণ্য রপ্তানিতে প্রতিটি কনসাইনমেন্টের সাথে টেস্ট রিপোর্ট পাঠানোর বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার করা হয়।  


মৎস্য অধিদপ্তর আপামর জনগোষ্ঠীর জন্য প্রাণিজ আমিষের চাহিদাপূরণে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি নিরাপদ মাছ সরবরাহে অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং সে লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তবে একক প্রয়াস এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। এজন্য প্রয়োজন নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য সরবরাহ এবং ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত সকলের সমন্বিত উদ্যোগ। এর ফলে অর্জিত হবে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধান, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত আর্থসামাজিক উন্নয়ন। বাস্তবায়িত হবে সরকারের উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার।

মহাপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর, রমনা, ঢাকা, ফোন : ৯৫৬২৮৬১, (ইমেইল: dg@fisheries.gov.bd)

 


COVID19 Movement Pass Online Police Clearance BD Police Help line Expatriate Cell Opinion or Complaint NIS Bangladesh Police Hot Line Number Right to Information PIMS Police Cyber Support for Women BPWN Annual Training Workshop Achievement & Success PHQ Invitation Card
Press Release Recruitment Information Procurement / Tender Notice Legal Instrument Innovation Corner Detective Magazine Bangladesh Football Club Diabetes-Covid19 Exam Results Accident Info Important Forms

Apps

icon icon icon icon icon icon